শেষের কবিতা - রবি ঠাকুর

২:৪০:০০ PM Kingshuk 0 Comments

জীবনে এরকম কিছু সময় এসেছে যখন এই কবিতা পড়েছি আর কপল বেয়ে দু এক ফোটা নোনা জল বহায়েছি। 
তাই লিখে রেখে দিলাম ভার্চুয়াল ডাইরির পাতায়।
===========================================================================

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।
                   তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
                             ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল--
                             তুলে নিল দ্রুতরথে
                   দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
                             তোমা হতে বহুদূরে।
                             মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
                             পার হয়ে আসিলাম
          আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়,
          রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
                             আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
                             দূর হতে যদি দেখ চাহি
                                      পারিবে না চিনিতে আমায়।
                                                হে বন্ধু, বিদায়।
কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে,
                            বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
                            ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
                            তোমার প্রাণের প্রান্তে; বিস্মৃতপ্রদোষে
                            হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা-স্বপ্নের মুরতি।
                            তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়,
                            সে আমার প্রেম।
                            তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশে।
                            পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
                                      কালের যাত্রায়।
                                      হে বন্ধু, বিদায়।
                            তোমার হয় নি কোনো ক্ষতি
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃত-মুরতি
                            যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
                                                হোক তব সন্ধ্যাবেলা।
                                                পূজার সে খেলা
          ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লানস্পর্শ লেগে;
                   তৃষার্ত আবেগবেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবেদ্যের থালে।
তোমার মানসভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়,
                   তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
                   আজও তুমি নিজে
                   হয়তো বা করিবে রচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন।
                   ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
                                      হে বন্ধু, বিদায়।
                   মোর লাগি করিয়ো না শোক,
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।
                   মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
                   সেই ধন্য করিবে আমাকে।
                   শুক্লপক্ষ হতে আনি
                   রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
                                      যে পারে সাজাতে
                   অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ-রাতে,
                   যে আমারে দেখিবারে পায়
                                      অসীম ক্ষমায়
                   ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
          এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
                   তোমারে যা দিয়েছিনু, তার
                   পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।
                   হেথা মোর তিলে তিলে দান,
          করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান
                   হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।
ওগো তুমি নিরুপম,
                                      হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান;
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
                             হে বন্ধু, বিদায়।


 শ্রী রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর
  ব্যালাব্রুয়ি। বাঙ্গালোর, ২৫ জুন, ১৯২৮