নীল হিমুর প্রহর - পর্ব ০৬
ইচ্ছা আছে ঘরে বসে জোছনা বিলাস করবো।
আমার খাটের পাশেই জানালা। বিশাল জানালায় না আছে কোনো পাল্লা না আছে গ্রিল। বাতাস বৃষ্টি জোছনা রোদ আর চোর নির্দিধায় আমার ঘরে ঢুকে পরতে পারে। বেপারটা আমার ভালোই লাগে। ইচ্ছে ছিলো খটে শুয়ে নিরিবিলি জ্যোৎস্না দেখবো। কিন্তু আমার পাশের ঘরে সিয়াম নামের একটা ছেলে থাকে। সে আমার ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিয়েছে। ক্যাসেট প্লেয়ার বা এ ধরনের কোনো যন্ত্রে সে স্বশব্দে গান বাজাচ্ছে।
"অন্ধকার ঘরে, কাগজের টুকরো ছিঁড়ে, কেটে যায় আমার সময়..."
গান টা এমনি সময়ে অসাধারন। কিন্তু বর্তমানে তা আমার নিকট অত্যধিক বিরক্তির কারন। আমার জোছনা বিলাস সফল হচ্ছে না। মনোযোগ চলে যাচ্ছে গানের দিকে। উঠে গিয়ে বললেই গান বন্ধ করে দেবে। কিন্তু এই সময় ঊঠতে ইচ্ছে করছে না।
হঠাৎ গান থেমে গেলো। আমি খুশি হলাম। কিন্তু সুখ আমার কপালে সয় না। দরজায় খট খট শব্দ। ওপাশে সিয়াম।
"হিমুদা, ও হিমুদা... ঘুমিয়ে গেছো? দরজাটা খোলো..."
আমি তাকে দরজা ঠেলে ভেতরে আসতে বললাম। সে নিখুত ভাবে কোন প্রকার শব্দ ছাড়াই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। এবং আগের মত শব্দহীনভাবে দরজা লাগিয়ে দিল।
- হিমুদা, কেমন আছো?
- ভালো নাই।
- কেন? আমি জোরে গান বাজিয়েছি বলে তুমি রাগ করনি তো?
- ভালো না থাকার কারন ধরতে পেরেছিস।
ছেলেটা চুপসে গেলো। রাজ্যের আধার তার সুন্দর গোল মুখে ভর করেছে।
তার প্রতি আমার রাগ ক্রমশই মায়ায় পরিনত হচ্ছে।
- কি বলতে এসেছিস বলে ফেল। আমি ভালোই আছি। এমনি মজা করেছি তোর সাথে।
- সত্যি? আমি যা ভয় পেয়েছিলাম বাবা। এখন শান্তি পেলাম।
-কি বলতে এসেছিস, বলে ফেল।
-ও হ্যা। আমি এই মোবাইল ফোন টা আজকে কিনলাম। খাস চাইনিজ ফোন। এতক্ষন অরধেক ভলিউমে গান বাজাচ্ছিলাম। এই যে দেখো।
বিশাল একটা ফোন। আমার ফনের প্রায় চার গুন বড় হবে। আমি নেড়েচেড়ে দেখছি। আর ও সদ্য কেনা ফোনের বৃত্তান্ত বর্ননা করছে।
আমি মনোযোগি শ্রোতার ভুমিকা পালন করছি। শুনতে ভালোও লাগছে না আবার খারাপও লাগছে না। আমি শুধু হু হা করে যাচ্ছি।
এমন সময় আবার কে যেন দরজায় কড়া নাড়লো। আমি ভ্রু কুচকে দরজার দিকে তাকালাম। কে হতে পারে সেটা ধারনা করারা চেষ্টা করছি। সিয়ামও দরজার দিকে তাকালো। তার বক্তৃতায় ছেদ পরেছে। সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল," খুলবো?" আমি বললাম দরজা খোলাই আছে। উঠে যেয়ে খুলুতে হবে না।
আগুন্তুকের পরিচয় কি হতে পারে মাথায় আসছে না। রুপা নয় তো? এত রাতে তার আসার সম্ভাবনা কতটুকু? এই অসময়ে তার আসার কারন কি হতে পারে? সে কি একা এসেছে?
আগন্তুক অনুমতি ব্যতীত দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। সিয়াম যতটুকু নিশ্বব্দে দরকা খুলেছে সে ততটুকুই স্বশব্দে দরজা খুলেছে।
আগন্তুক আমার সু পরিচিত। টোকাই সরদার। আমার দিকে তাকিয়ে সব গুলো দাত বের করে হাসছে।
- কি রে, জেল থেকে ছাড়া পেলি কবে? *
- আইজ বৈকালে।
- তুই একাই এসেছিস? নাকি ইদ্রিসও এসেছে?
- উনারে তেনারা ছাড়ে নাই।
- কেন?
- উনি নাকি স্বপ্ন দেখছে, আফনে তার মাথায় ঠ্যং (পা) ছুয়াইয়া আশিব্বাদ (আশির্বাদ) করবেন তারপর তারে ছাড়াইয়া আনবেন।
- ও আচ্ছা।
টোকাই সরদার আমার পায়ের কাছে নিচে বসেছে। আমার পা ধরে বারবার বলছে, "আমারে বর দে্ আমারে বর দেন"
আমি বর দেবার কেউ না। আমি সামান্য মানুষ। সত্যিকার হিমুর কিছু অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। সে তাকে সম্ভবত বর দিতে পারতো। কিন্তু আমি এখন না করলে সে শুনবে না। আমি যে খুব সামান্য একজন সাধারন মানুষ ছাড়া আর কেউ না তা সে বিশ্বাস করবে না। আমার উদ্ভট কিছু বলে তাকে বুঝাতে হবে।
- টোকাই সরদার...
- জে মাটিপিতা, বান্দা হাজির।
- আজ জোছনা রাত। এরকম ভরা পুর্ণিমায় যেদিন বৃষ্টি হবে সেদিন রাতে সম্পুর্ণ বস্ত্রহীন অবস্থায় বৃষ্টিতে ভিজতে হবে আর হেটে হেটে চাঁদ দেখতে হবে। যদি ঠিক ঠাক করতে পারিস তখন আমার বর এম্নিতেই তোর উপর এসে পরবে।
- জে অবশ্যি। আমি অবশ্যি অবশ্যি করুম। দুইনা (দুনিয়া) লন্ডভন্ড হইলেই করুম।
- আচ্ছা। আজকে যা।
- জে আচ্ছা। সেলাম।
সে ধীর পায়ে চলে গেলো। যাবার সময় আগের মত শব্দ করে নয় বরং সিয়ামের মত নিশব্দে দরজা লাগিয়ে গেছে।
সিয়াম আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চাহনিতে স্পষ্ট বিস্ময় আর একটাই প্রশ্ন, আমিও যদি এরকম করি তবে আমিও কি বর পাব?
সে মুখ ফুটে প্রশ্ন করতে পারে নি। আমিও মুখে কিছু বলি নাই। চোখে শুধু প্রশ্রয় ছিলো।
* পাঠক, টোকাই সরদার আর ইদ্রিস এর জেল হাজতের ঘটনা একটি বিশেষ পর্বে লিখবো।
[[কিংশুক২০১৫জুলাই২২সিরাজগঞ্জ২২৪১]]
1 টি মন্তব্য:
g
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন