নীল হিমুর প্রহর - পর্ব ০৪

১:০১:০০ PM Kingshuk 0 Comments

[চতুর্থ পর্ব]

ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। 
সবে সন্ধ্যা নেমেছে। ঢাকা শহরের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা-রাত এরকম কোনো ব্যাপার নেই। শুধু দিন বা রাত। তাই সন্ধ্যা নামার সৌন্দর্য দেখা যায় না। ভোরের আলো আর সন্ধ্যার আঁধার মানুষের মনের ভেতর একটা আলাদা প্রভাব ফেলে। আর এই শহরের মানুষ এই দুই জিনিস থেকেই বঞ্চিত । সম্ভবত এই জন্যেই মানুষগুলো খুব বেশি একগুঁয়ে। মনের ভেতর আবেগ নাই। ভালোবাসাও নাই।
আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি এক বিলাসবহুল হোটেল এর সামনে। ইচ্ছা ছিল ভেতরে যাব। কিন্তু দারোয়ান দিচ্ছে না। না দেয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল। সে নীরব। ঢুকতে না দেয়ার একটা কারণ হতে পারে আমার বেশভূষা। অত্যন্ত জঘন্য। নীল পাঞ্জাবী প্রায় কালচে হয়ে গেছে। আর দুর্গন্ধে কথা না হয় বাদই দিলাম। গত তিন দিন রাস্তায় নিশিযাপন করেছি। একদিন রমনায়। একদিন ছিলাম জয়দেবপুর জংশনে। কাল ছিলাম বুড়িগঙ্গায়। বুড়িগঙ্গার নিশিবাস ছিল সবচেয়ে স্মরণীয়।
 
আমি আবার গেটের সামনে গেলাম –
 

    — ভাই সাহেব। একবার শুধু ঢুকতে দেন। ভেতরে জরুরী মিটিং আছে। আমি বিনা মিটিং শুরু হবে না।
 
    — আপনাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া যাবে না। আপনি চলে যান।
    — কেন জনাব। সমস্যা কি?
    — আরে ভাই, জ্বালাইয়েন না তো। আপনেরে এই সুরতে ঢুকতে দিলে আমার চাকরি থাকব না। বাসায় তিন তিন টা মেয়ে। বড় জনের বিবাহের বয়স হয়েছে।
    — ভাই। আপনি বুঝতে পারতেছেন না। ভেতরে আমার জরুরি মিটিং আছে।
আমাকে একবার ঢুকতে দেন আমি আপনার মেয়ের বিবাহের ব্যবস্থা করে দিব।

সে একবার আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। আমার কথা বিশ্বাস করার কোন কারণ নাই। সে বিশ্বাস ও করে নাই অবশ্যি। কিন্তু আমার ব্যঙ্কে যে পরিমান টাকা আছে তা দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় কয়েক হাজার বিয়ে এই হোটেলে করিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আগে দর্শনদারি তারপর ব্যাকগ্রাউন্ড বিচারী।
 
আমি গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আমি ফোন ব্যবহার করি না। অতি বিরক্তিকর জিনিস। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই বস্তু কাছে থাকলেই ভালো হত। আশেপাশের কারো কাছ থেকে ফোন নিয়ে কথা বলা যায়। কিন্তু কেউ আমাকে কথা বলার জন্য ফোন দেবে এরকম কোনো সম্ভাবনা নাই। পকেটে ছেঁড়া দুইটা দুটাকার নোট আছে। একটার অবস্থা অত্যধিক খারাপ। দোকান থেকে ফোন করার উদ্দেশ্যে আমি রওনা দিলাম।
আশেপাশে  তেমন কোনো দোকান পাট নাই। রাস্তাটা সুন্দর। আমি ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম। কিছুক্ষণ পর পর ট্রাক যাচ্ছে। আশেপাশে মানুষজনও খুব বেশি নাই। ঢাকা শহর সাড়ে ১০ টা নাগাদ এমন জনহীন হয়ে পড়বে ভাবা যায় না। কালকে হরতাল টরতাল নাকি কে জানে। হরতালের আগের দিন রাতে গাড়ি পোড়ানো হয় বেশি। কেউ বের হতে চায় না। আজ কি সেরকম কোনো দিন?
রাস্তার এই অংশে আলো খুব বেশি না। আলো আঁধারী। আমার পাশ দিয়ে একটা সাইকেল ক্রিং ক্রিং করতে করতে যাচ্ছে। চলছেও খুব আস্তে। ফাকা রাস্তায় আস্তে চালানোরও কারণ নাই আবার ক্রিং ক্রিং করারও কারণ নাই। লোকটার মাথায় বোধয় ছিট আছে। কাঁধে একটা ব্যাগের মত ঝোলানো। ব্যাগের দিকে তার নজর চোখে পড়ার মত। আমার থেকে একটু সামনে চলে গেছে সাইকেল ওয়ালা।
হঠাৎ করে ধুপ করে সাইকেল ওয়ালা পরে গেল। সাইকেলের সামনের চাকা খুলে গেছে। চাকাটা ঘুরতে ঘুরতে এসে তার উপরই পরলো। বেপারটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু আমার তীব্র হাসি পাচ্ছে। এখন আস্তে হাসলেও শোনা যাওয়ার কথা। আমি অনেক কষ্টে হাসি থামানোর চেষ্টা করছি। পেছন থেকে হঠাৎ স্বজোরে হর্ণ দিতে দিতে এগিয়ে আসছে একটা ট্রাক। তীব্র আতঙ্ক কাজ করছিলো আমার মনে। হিমুদের ভয় পেতে নাই। কিন্তু আমি তীব্র ভয় পাচ্ছি। হঠাৎ দেখি আমার বাম পায়ের নিচে মাটি নাই। ঢাকনা ছাড়া ম্যানহোলের মধ্যে বাম পা ঢুকে গেছে।
আরে, আমি এখন কি করবো? পেছনে ধেয়ে আসছে ট্রাক। তীব্র হর্ণ। মিসির আলি সাহেব এরকম অবস্থায় থাকলে কি করতেন? যুক্তি দিয়ে বের করতেন যে আমার কোনো ক্ষতি নাই। আমি রাস্তার পাশে উচু ফুটপাতে। ট্রাক ফুটপাতে উঠবে না।
আসলেই মানুষ হাস্যকর চিড়িয়া। পৃথিবীর সব থেকে বুদ্ধিমান অথচ অত্যাধিক ভীতু। আমি ম্যনহোল থেকে পা বের করতে ব্যস্ত। হঠাৎ করেই কানে ভেসে আসলো আর্তনাদের চিৎকার। আমি তাকিয়ে দেখি সাইকেল ওয়ালার মাথার খুলি গুড়া করে দিয়ে গেছে ট্রাকটা। রক্তাক্ত চারিপাশ। ঘিলু ছিটকে পড়েছে চতুর্দিকে। আমি হঠাৎ কেমন জানি ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। বিপদের মাত্রা এতটাই বেশি যে ম্যনহোল থেকে পা একা একাই বের হয়ে এসেছে।
ছোকড়া মতন একটা ছেলে কোত্থেকে উড়ে এসে সাইকেল ওয়ালার পা থেকে জুতা জোড়া খুলে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আকস্মিক ঘটনায় আমি স্থবির।
পাশে দিয়ে পর পর দুইটা রিকশা যাচ্ছে। প্রথম রিকশার যাত্রী ভদ্রলোক এক্সিডেন্ট স্পট দেখে রিকশাওয়ালা কে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, “ অই মিয়া তাড়াতাড়ি টানেন। পুলিশ আসলে হুদাই প্যারা। ”
পেছনের রিকশায় দুজন লোক। একজন সামনের রিকশার লোকটিকে উদ্দেশ্য করে গালি দিল। তার কথার মোরাল হচ্ছে মানুষ মানুষের জন্যে । তারা রিকশা থেকে দ্রুত নেমে রেস্কিউ মিশন শুরু করে দিয়েছে।
মোটা লোকটার দৌড়া দৌড়ি দেখার মত।  তার প্রতি কেন জানি শ্রদ্ধাবোধ জন্মালো। হঠাৎ সে সাইকেলওয়ালার ব্যাগ খুলে ভেতরে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তাকে এখন খুব নার্ভাস লাগছে। নড়াচড়াও করছে সাবধানে। এদিকে লম্বাজন সাইকেলওয়ালার পকেট থেকে মোবাইল বের করে এনেছে। মোটা লোকটা লম্বাজনকে ডেকে কি যেন বললো।  এখন দুইজনই নার্ভাস। তাদের ফিসফিসানিতে শুধু একটা শব্দই শুনতে পেলাম, “টাকা” ।
লম্বাজন সাইকেলওয়ালার মোবাইল ফোনটা পাশে ফেলে দিল এবং টাকার ব্যগটা নিয়ে রিকশায় করে দ্রুত চলে গেল।  মানুষ এখন আর মানুষের জন্য না। মানুষ এখন টাকার জন্য। সবার উপরে টাকা সত্য তাহার উপরে নাই অবস্থা।
আমি ততক্ষণে ডেডবডির কাছে চলে এসেছি। মোবাইল ফোনটা তুলে হাতে নিলাম। সাথে সাথেই বেজে ওঠা শুরু করলো। কন্টাক্ট নাম্বার “অরু” নামে সেভ করা। একটা ৩-৪ মাস বয়েসের বাচ্চার ছবি পুরা স্ক্রিন জুড়ে।
রাত প্রায় পৌনে বারোটা। সম্ভবত অরু তার স্ত্রীর নাম। অনেক রাত হয়েছে। ছোট বাচ্চা নিয়ে একা একা ভয় পাচ্ছে। স্বামীকে ফোন করেছে কিছু সাহস সঞ্চয়ের প্রত্যাশায় আর দ্রুত বাসায় ফেরার তাগাদা দিতে। সে মা জানে না যে খোকার বাবা আর কোনদিন, কোনোদিনই  ফিরবে না ।

কে যেন হঠাৎ করে আমার খুব খুব খারাপ লাগা শুরু করলো। চোখ ছলছল করছে কিনা কে জানে।
হিমুদের কোনো মায়া থাকতে নেই। হিমুরা সকল আবেগের ঊর্ধ্বে। কিন্তু আমি কান্না থামাতে পারছি না। আচ্ছা, আমি কি হিমু হতে পারবই না?



[[কিংশুক২০১৫নভেম্বার১৯শান্তিবাগ,ঢাকা০১২১]]