নীল হিমুর প্রহর - পর্ব ০৭
আজ ঈদের আগের দিন।
বাজারে উপচে পড়া মানুষের
ভীড়। শেষ মুহুর্তে মানুষের মনে পরেছে যে এটা ওটা কেনা এখনো বাকি। কিনতেই হবে। না
কিনলে কালকে কোরবানী দেয়া অসম্ভব।
শপিং মলের আনাচে কানাচে
তারুণ্যের জোয়ার। বেশির ভাগের উদ্দেশ্যই শপিং না। তারা এসেছে মজা করতে।
আমি রাত ৯ টা পর্যন্ত হেঁটে বেড়িয়েছি রাজপথে। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। রাত যত গভীর হচ্ছে রাস্তায় নারী
সংখ্যা বেড়ে চলেছে আর পুরুষ কমছে। যুবকেরা যখন অনেক রাত হয়েছে বলে বাড়ি ফিরছে
যুবতিরা তখন মাঠে নামছে। তবে তাদের বাইরেও একটা দল আছে যারা আগে পরে সবসময়
যুগলবন্ধী। তাদের পৃথিবীতে প্রেরণের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে যুগলবন্দী অবস্থায়
যত্রতত্র বসে বসে মধুর মুহুর্তের সৃষ্টি করা।
আমি আমার ছোট কুঠরিতে
ফিরছি। আজকে রাতে মানুষ ঘুমাবে না। তাই আজ আমার ঘুমানোর পালা।
একটা অন্ধকার চিপা গলির
ভেতর ঢুকেছি। একটা একতলা বাড়ির বারান্দায় ১০০ ওয়াট এর হলদে বাল্ব জ্বালানো। এখন
কেউ এরকম বাল্ব ব্যবহার করে না। সেই বাড়ীর পাশে রাস্তার দিকে একটা গাছ আছে। সুগন্ধ
ছড়াচ্ছে। কি গাছ জানা গেলে ভালো হত। এই মুহূর্তে সুগন্ধী ফুলের গাছের নাম মনে করতে
পারছি না। আমি গাছের নিকটবর্তি। গাছ তীব্র গন্ধে আমাকে প্রায় অর্ধমাতাল করে
ফেলেছে। দূরে আবছা আলোয় আমি একজন মানুষ দেখলাম। সম্ভবত লাল শাড়ি পড়া। বাড়ির ভেতর
থেকে একটা গান ভেসে আসছে। পুরনো গান। হেমন্ত বাবুর সম্ভবত।
“ আমি দূর হতে তোমারে
দেখেছি
আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি
বাজে কিনি কিনি রিনিঝিনি
আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি
বাজে কিনি কিনি রিনিঝিনি
তোমারে যে চিনি চিনি
মনে মনে কত ছবি এঁকেছি”
হঠাৎ করে মনে হলো আমি
মেয়েটিকে চিনি। মেয়েটা রুপা। কিন্তু রুপা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে অনেক আগেই। সে তার
সেলেব্রেটি স্বামীকে নিয়ে সুখে আছে। তার এখানে থাকার কথা না।
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম।
রাত সাড়ে দশটা বাজে। সামনে ল্যম্পপোস্ট। একটা কুকুর ক্যু ক্যু শব্দ করে দৌড়ে চলে
যাচ্ছে। আমার মনে হলো আমারো উচিত দ্রুত পায়ে এলাকা ত্যাগ করা।
আমি আমার ঘরে ফিরলাম রাত
পৌনে ১২ টার দিকে। ঘামে ভেজা চপচপে পাঞ্জাবিটা খুলে রেখে খোলা জানার পাশে হেলান
দিয়ে বসেছি। আমার হাতে অসম্ভব সুন্দর একটা জিনিস। জিনিসটা একজন বিশেষ মানুষ
দিয়েছিলো বলেই সুন্দর। এমনিতে খুব সাধারন একটা জিনিস। কিন্তু আমার কাছে অসাধারন।
একটা মোবাইল ফোন। সেখানে রুপার নাম্বার সেভ করা আছে। এই জিনিসটার জন্যেই আজ রুপা
আমার কাছে নাই। অসম্ভব বড়লোক একজনকে বিয়ে করে সে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। একদিক
থেকে ভালই হয়েছে। মেয়েটা বেচে গেছে। কালকে ঈদ। ইচ্ছে করছে ফোন করে বলি, “কেমন আছো
রুপা। আজকে ঈদ তাই উইশ করতে ফোন করেছি। তুমি কি বিরক্ত হয়েছো?”
ফোন করতে ভয় করছে। কিসের
ভয়? হিমুদের তো ভয় থাকা যাবে না। তবুও ভয় করছে। তারচেয়ে বরং একটা এসএমএস পাঠানো
যেতে পারে।
আমি লাল বাটনে চাপ দিয়ে
আলো জ্বালালাম। দুইটা মিসড কল আর একটা এসএমএস।
রুপা দুবার ফোন করেছিলো।
না পেয়ে একটা এসএমএস পাঠিয়েছে। আমি এ জীবনে রুপার কল ধরতে পারলাম না। নিজের উপর
খুব বিরক্ত লাগছে। এসএমএস এ হয়তো কিছু জরুরী কথা বলা আছে। কিন্তু চিঠি পাওয়া
মাত্রই পড়তে হয় না। কয়েক সপ্তাহ ফেলে রাখতে হয়। তারপর পড়তে হয়। এতে চিঠি পড়ার একটা
মজা আছে। অনেক জল্পনা কল্পনা মিশ্রিত চিঠি। এসএমএস এর ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
আমার উচিত এসএমএস না পড়ে
ফেলে রাখা। কিন্তু খুব ইচ্ছে করছে রুপার এসএমএস টা পড়তে। আমার সাথে রুপার যোগাযোগ
করার কোনোরূপ কারন নাই।
খুব কষ্ট হচ্ছে। পুরানো স্মৃতিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। সেই সব
মুহুর্তগুলো যখন সে আমার সাথে ছিলো।
হিমুদের দুঃখবোধ থাকতে
নাই। হিমুরা সকল মানবীয় আবেগ এর উর্ধে। তবুও খুব কষ্ট হচ্ছে।
আমি তার জন্য পথ চেয়ে
থেকেছি বহু নিশিত রজনি। তার একটা এসএমএস অথবা ফোন কল মিস করবো না বলে রাতের পর রাত
জেগে থেকেছি নির্বাক যন্ত্রটিকে হাতে ধরে আর আজ সে যখন এসেছে আমি তখন নির্বাক।
আমি বোধয় হিমু হতে পারবো
না কোনো দিনও। আমি আমার প্রিয় ফোনটা জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম পচা নর্দমায়।
সে আমাকে কোনোদিন আর খুজে
পাবে না। আর আমিও না।
তাকে আর বলা হলো না, “কেমন
আছো রুপা। আজকে ঈদ তাই উইশ করতে ফোন করেছি। তুমি কি বিরক্ত হয়েছো?”
পৃথিবী খুব সুন্দর।
সুন্দর পৃথিবী ঘুরিতেছে।
[[কিংশুক২০১৫সেপ্টেম্বর২৪সিরাজগঞ্জ২৩১৭]]
0 টি মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন